মহারাজ সুরজমলের মৃত্যুবার্ষিকী ২৫শে ডিসেম্বর পালিত হয়, কারণ এই দিনেই মুঘল সেনারা দিল্লির শাহদরা-তে অতর্কিত হামলা করে তাঁকে শহীদ করেছিল। মহারাজ সুরজমল, যিনি জাঠ সাম্রাজ্যের মহান শাসক হিসাবে পরিচিত, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৭০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বীরত্ব, ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সাথে তিনি শুধু নিজের সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেননি, বরং ভারতীয় রাজনীতি ও যুদ্ধবিদ্যায়ও এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সুরজমলের শাসন বর্তমান উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল, যার মধ্যে দিল্লি, আগ্রা, আলিগড় এবং ভরতপুরের মতো প্রধান অঞ্চলগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরকাল অমিট থাকবে, বিশেষ করে জাঠদের সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে তুলে ধরার জন্য।
সুরজমলের জীবন সংগ্রাম ও বিজয়
মহারাজ সুরজমলের জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। তিনি ছিলেন এমন এক রাজা যিনি মুঘল, মারাঠা এবং রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ করে নিজের রাজ্য রক্ষা করেছিলেন। সুরজমল তাঁর শৌর্য ও রণকৌশল দিয়ে শুধু নিজের রাজ্যেই নয়, বরং সমগ্র উত্তর ভারতে নিজের পরিচিতি তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন এক দক্ষ রাজনীতিবিদ, শক্তিশালী শাসক ও মহান যোদ্ধা। তাঁর শাসনকালে ভরতপুর দুর্গ, যা লোহাগড় দুর্গ নামেও পরিচিত, একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছিল। এই দুর্গটি মুঘলদের দ্বারা বহুবার আক্রান্ত হওয়ার পরেও কখনও জয় করা যায়নি।
সুরজমলের সামরিক দক্ষতা
মহারাজ সুরজমল তাঁর নীতিতে সর্বদা বিচক্ষণতা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি তাঁর রাজ্যের সুরক্ষার জন্য অনেক যুদ্ধ করেছেন এবং বিভিন্ন জোট তৈরি করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত যুদ্ধ ছিল কুম্ভেরের যুদ্ধ, যেখানে তিনি মারাঠাদের পরাজিত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সুরজমল তাঁর রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিতেন এবং যখনই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠত, তিনি সম্পূর্ণ দক্ষতা দিয়ে তা লড়তেন।
রাজনৈতিক দৃষ্টি ও দূরদর্শিতা
মহারাজ সুরজমলের দূরদর্শিতা তাঁকে অন্যান্য সমসাময়িক শাসকদের থেকে আলাদা করেছিল। তিনি সর্বদা সময়ের গতি বুঝতে পারতেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তে খুব ভারসাম্য বজায় রাখতেন। তিনি কেবল যুদ্ধেই সাফল্য পাননি, বরং তাঁর রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধিও সুনিশ্চিত করেছিলেন। সুরজমল জয়পুরের মহারাজ জয়সিংহের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং তাঁর পুত্র ঈশ্বরী সিংকে সমর্থন করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি মুঘল ও মারাঠাদের সাথেও বেশ কয়েকটি চুক্তি করেছিলেন, যা তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতাকে প্রমাণ করে।
সুরজমলের সংগ্রাম ও তাঁর মহিমা
মহারাজ সুরজমলের সবচেয়ে বড় সংগ্রাম ছিল ১৭৬৩ সালে, যখন নাজিবুদ্দৌলার নেতৃত্বে মুঘলরা তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করে। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসে তাঁর অবদান কখনও শেষ হবে না। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে যে শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা আজও ভারতের সামরিক ও রাজনৈতিক ধারাকে প্রভাবিত করে। তিনি কেবল জাঠদের মহান নেতা ছিলেন না, বরং ভারতীয় রাজনীতিতেও এক অনন্য স্থান রাখেন।
সুরজমলের উদারতা ও মানবিকতা
মহারাজ সুরজমলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর উদারতা ও মানবিকতা। যখন মারাঠার সৈন্যরা যুদ্ধে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল, তখন সুরজমল তাঁদের নিজের রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি মারাঠাদের আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করিয়েছিলেন, তাঁদের খাদ্য ও বস্ত্র দিয়েছিলেন এবং তাঁদের ভালোভাবে যত্ন নিয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর মহানুভবতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যা তাঁকে কেবল একজন রাজা হিসেবেই নয়, একজন মানুষ হিসেবেও বিশিষ্ট করে তোলে।
সুরজমলের শেষ সংগ্রাম
২৫শে ডিসেম্বর, ১৭৬৩ সালে, নাজিবুদ্দৌলা এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মহারাজ সুরজমলকে হত্যা করেন। এই ঘটনা ভারতীয় ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সুরজমলের মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যের অনেক ক্ষতি হয়, কিন্তু তাঁর অবদানকে কখনও ভোলা যাবে না। তাঁর জীবন সংগ্রাম, সাহস ও উদারতার উদাহরণ হয়ে ভারতীয় ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
মহারাজ সুরজমল শুধু একজন মহান শাসক ছিলেন না, বরং তিনি তাঁর রাজ্য এবং প্রজাদের জন্য যে ত্যাগ ও সাহস দেখিয়েছেন, তা আজও অনুপ্রেরণা দেয়। তাঁর নেতৃত্বে জাঠ সাম্রাজ্য যে শক্তি ও সম্মান অর্জন করেছিল, তা ভারতীয় ইতিহাসের স্বর্ণালী পাতায় সবসময় লেখা থাকবে। তাঁর বীরত্ব, দূরদর্শিতা এবং মানবতা আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে।